ডা. জাহেদ উর রহমান : সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গত ১৮ জুলাই ২০১৯ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন যে

“…প্রতিবারই জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনের সময় মনে পড়ে। বেশ কয়েক বছর থেকেই খেয়াল করছি, ওই সম্মেলনে আমাদের জেলা প্রশাসকরা দাবির এক লম্বা ফিরিস্তি দেন।
দাবিগুলো দেখলে মনে হয়, তারা চান একটা জেলার সব ধরনের প্রশাসনিক ক্ষমতা তাদের হাতে কুক্ষিগত হোক। আমাদের রাষ্ট্রে যেমন সব ক্ষমতা এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছে একজন প্রধানমন্ত্রীর হাতে, তেমনি জেলা প্রশাসকরাও চাইছেন হয়ে উঠতে জেলায় দায়িত্ব পালনরত এক একজন ‘জেলা প্রধানমন্ত্রী’।
এ বছরের ডিসি সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত করা কার্যপত্রে ৩৩৩টি প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর মধ্যে অন্তত ১৫টি প্রস্তাব আছে, যেগুলো অন্য দফতরের এখতিয়ার। সেগুলোও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে চান ডিসি ও ইউএনওরা। তারা চাইছেন তাদের হাতে থাকা বিপুল ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ করতে।
শুধু জেলা-উপজেলা নয়, ডিসিদের নজর পড়েছে স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদেও (ইউপি)। ইউপি চেয়ারম্যানদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোনো কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেরি হলে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দিতে চান ডিসিরা।
এ ছাড়া জেলায় এসপির বাইরে আলাদা পুলিশ ফোর্স, উপজেলার প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অফিসারকে (পিআইও) উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) অধীনে আনার প্রস্তাবও করেছেন তারা।
সেই সঙ্গে জেলা-উপজেলায় আয়কর আদায়, ফৌজদারি অপরাধ বিচারের ক্ষমতা, কোটি টাকার থোক বরাদ্দ, এনজিও কার্যক্রম তদারকি, ডিপিপি প্রণয়ন, মোবাইল কোর্টের অধীনে নতুন নতুন আইন অন্তর্ভুক্তকরণ, জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটিতে ডিসিদের সভাপতি, উপজেলা শিক্ষা কমিটিতে ইউএনওদের সভাপতি করার প্রস্তাব করা হয়েছে।”
উক্ত নিবন্ধে তিনি আরও বলেন যে-
“বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে পদে পদে বাধা সৃষ্টি, এমনকি বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পরও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে চাওয়া আর সেটার ব্যাপ্তি বাড়ানো নিয়ে তাদের ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং এবারও ফৌজদারি অপরাধ আমলে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিচারিক ক্ষমতা চেয়ে ডিসিরা প্রমাণ করছেন তাদের সবকিছুর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হওয়ার ঔপনিবেশিক মানসিকতাই সত্য, বাকি সবই মিথ্যে। মাসদার হোসেন মামলার সুস্পষ্ট রায়ের পরও তারা এসব দাবি করাটা স্রেফ রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন।?”

এখন প্রশ্ন হলো নির্বাহী বিভাগের ডিসি সাহেবরা বিচার বিভাগের উপর আর কত মাত্রায় তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করবেন? দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে একাধিক সার্কুলার এর মাধ্যমে সকল অধস্তন আদালতসমূহে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে যার আওতায় সকল অধস্তন আদালত সমূহ তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখিবেন ইহাই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সার্কুলারের মাধ্যমে প্রদত্ত নির্দেশ। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে প্রদত্ত গত ৪.৪.২০২০ ইংরেজি তারিখের সার্কুলারে একথা বলা হয়েছে যে দেশের প্রত্যেকটি জেলায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এক বা একাধিক জুডিসিয়াল বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শুধুমাত্র জরুরি মামলার ক্ষেত্রে কর্তব্যরত আছেন।

এই ব্যতিক্রম হলো এই জন্য যে, যেকোনো অপরাধীকে পুলিশ কর্তৃক আটক করা হলে সাংবিধানিকভাবে নিকটবর্তী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট ২৪ ঘন্টার মধ্যে উপস্থাপন করার বাধ্যবাধকতা থাকায় এবং উক্ত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জরুরী মামলার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে উক্ত আটককৃত ব্যক্তিকে যে কোনো কাস্টডিতে প্রেরন করিবেন। গত ১১.০৪.২০২০ ইংরেজি তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে ১৯৯ নং সার্কুলার জারি করেন। এই সার্কুলার এবং পূর্বের সার্কুলারগুলোর কোনটিতেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার জন্য কোন প্রকার ব্যতিক্রমী নির্দেশনা প্রদান করেন নাই। যে ব্যতিক্রমী নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা শুধুমাত্র প্রত্যেক জেলায় এক বা একাধিক জুডিসিয়াল বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জরুরী মামলার কার্যক্রম করার জন্য। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে প্রদত্ত একাধিক সার্কুলার অনুসারে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট নিজে মামলার কার্যক্রম পরিচালনা হতে বিরত রয়েছেন এবং অন্যান্য সকল অধস্তন আদালতও মামলার কার্যক্রম পরিচালনা হতে বিরত থাকবেন ইহাই স্বাভাবিক। কিন্তু মোবাইল কোট একটি অধস্তন আদালত হলেও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উক্ত সার্কুলার গুলির প্রতি মূলত বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তাদের কার্যক্রম উক্ত সময় হতে আজ পর্যন্ত অবৈধভাবে পরিচালনা করিতেছেন। এখানে এ কথা বলা আবশ্যক যে, সংবিধানের ১১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট ব্যতীত আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য সকল আদালতই হলো অধস্তন আদালত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াও দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর ৪৩৫ ধারা অনুযায়ী সকল জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়রা জজের অধীনস্থ বলে গণ্য হইবেন। এ কারণে ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডারস, ২০০৯ এর ৪৭৬ রুল অনুযায়ী দায়রা জজগণ প্রত্যেক বছর কমপক্ষে একবার সকল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর বিচারিক বিষয় এবং আদালতের প্রশাসনিক বিষয় পরিদর্শন করে লিখিত প্রতিবেদন মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে প্রেরণ করিবেন। উপরোক্ত কারণে মোবাইল কোর্ট অবশ্যই সাংবিধানিকভাবে এবং আইনগতভাবে একটি অধঃস্তন আদালত যা বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্যান্য অধঃস্তন আদালতের মতো বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রদত্ত সার্কুলার অনুসারে কার্যক্রম না চালাতে বাধ্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যে, অতীতের ন্যায় বর্তমানেও নির্বাহী বিভাগের অধীনে এই বিষয়টি জেনে অথবা না জেনে ডিসি সাহেবরা বিভিন্ন নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেটগণের মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আসতেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে জরিমানা আরোপ করা হচ্ছে । জরিমানার টাকা গ্রহণ করা হচ্ছে। ট্রেজারি বন্ধ থাকার কারণে তাহা নিজেদের নিকট রাখতেছেন। অনেককে আবার জেলেও অন্তরীণ করা হচ্ছে। সবই হচ্ছে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সার্কুলার কে লংঘন করে পরিচালিত মোবাইল কোর্টের সাজা প্রাপ্ত ব্যক্তি নির্দোষ হলেও এই সময়ে আপিল, রিভিশন কিংবা উচ্চ আদালতে প্রতিকারের জন্য কোন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পার্তেছেন না।

প্রশ্ন হলো, এই বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের মাত্রা আর কতদিন চলবে? নাকি বিচার বিভাগের প্রতি নির্বাহী বিভাগের ইহা এক ধরনের কৌশল, যার মাধ্যমে যে বিচারিক ক্ষমতা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ হারিয়েছে সেই বিচারিক ক্ষমতা ডিসি সাহেবরা বর্তমান পরিস্থিতির অজুহাতে আবার ফিরে পেতে চাচ্ছেন এই যুক্তিতে যে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং অন্যান্য সকল অধঃস্তন আদালত যে সময়ে তাদের কার্যক্রম হতে বিরত রয়েছেন ঠিক সেই সময়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার মাধ্যমে জাতিকে স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আসলে কিছুই না, ইহা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে প্রদত্ত সার্কুলারকে পাশ কাটিয়ে মূলত বিচারবিভাগকে আরেকবার বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা। হয়তো আমার এ কথা নজরে আসার পর, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের মাধ্যমে তাদের এই ভুল সংশোধন করতে পারেন। সেটা ভিন্ন বিষয় তবে ইতিহাস থেকে মনে পড়ে লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে ১৭৯৩ সাল হতে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৫ বছর বিচার বিভাগের প্রকৃত পৃথকীকরণ করা হয়েছিল জন্য জেলা জজ শুধুমাত্র জেলা জজ ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একাধারে জেলা জজ এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তার পদবী ছিল জেলা জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট। আর বর্তমানের ডিসি সাহেবের পদবী ছিল শুধু জেলা কালেক্টর। লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে বিচার বিভাগের যে স্বাতন্ত্র্যবোধ ছিল সেই স্বাতন্ত্র্যবোধ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট যেদিন ফিরিয়ে আনবেন সেইদিন হয়তো বিচার বিভাগের প্রতি নির্বাহী বিভাগের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের মাত্রা থেমে যাবে।

মোঃতথ্যঃ আজিজুর রহমান দুলু সাবেক বিচারক এবং আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

Leave your comments