সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) কর্মরত সহশ্রাধীক পুলিশ সদস্যের ডোপ টেস্ট করা হয়েছে।বুধবার পর্যন্ত তাদের মধ্যে ৫০ জনের পজিটিভ পাওয়া গেছে। এতে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) শাখায় কর্মরত পুলিশ সদস্যের সংখ্যাই বেশি। এ বিভাগে ২৩ জন মাদকাসক্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পিওএম উত্তর ও পশ্চিম বিভাগে আটজন করে, পূর্ব বিভাগে পাঁচজন এবং দক্ষিণ বিভাগে দু’জন রয়েছেন। এছাড়া ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি বিভাগে সাতজন এবং কল্যাণ ও ফোর্স বিভাগে পাঁচজন রয়েছেন। অন্য বিভাগগুলোতে ১-২ জন করে সদস্যের মাদকাসক্ত ধরা পড়েছে। ডিএমপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ডোপ টেস্টে পজিটিভ সদস্যদের চাকরিচ্যুত করা হবে।ডিএমপি সদর দফতরের তালিকা অনুযায়ী- মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা বেশি। ৫০ জন মাদকাসক্তের মধ্যে ২৫ জনের ইয়াবা সেবনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৯ জনের বিরুদ্ধে গাঁজা সেবনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ছয়জনের বিরুদ্ধে হেরোইন সেবনের তথ্য মিলেছে। কারও কারও বিরুদ্ধে একাধিক নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছে। মাদকাসক্তদের বেশির ভাগের ব্যক্তিগত শুনানি শেষ করেছে ডিএমপির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। শুনানি শেষে অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে বিভাগীয় মামলা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। কয়েকজন অভিযোগ গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে। আবার কারও কারও বিভাগীয় মামলা তদন্তাধীন। ডিএমপিতে ডোপ টেস্ট শুরু হওয়ায় সারা দেশে মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যরা সতর্ক হচ্ছেন। ইতোমধ্যে অনেকে মাদকগ্রহণ ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে গোপনে চিকিৎসকের পরামর্শও নিচ্ছেন।রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ডোপ টেস্টে পজিটিভ আসার পর অনেক পুলিশ সদস্য চিকিৎসকের পরামর্শে মাদক ছেড়ে দিয়ে ফের টেস্ট করাচ্ছেন।টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে দুই সদস্য ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জ করেছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় তাদের ফলাফল নেগেটিভ এসেছে বলে তারা দাবি করেছেন। তবে প্রথমবার পজিটিভ আসার বিষয়টিকে তারা ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পল্লবী থানার এসআই আরিফ হোসেন মল্লিক বলেন, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ডোপ টেস্টে পজিটিভ (হেরোইন) আসার পর নিজ উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে (বিএসএমএমইউ) পরীক্ষা করিয়েছি। এতে আমার নেগেটিভ আসে। পরে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ জানালে কর্তৃপক্ষ ফের সেখানে (পুলিশ হাসপাতাল) পরীক্ষা করান। সেখানেও নেগেটিভ আসে। তবে এরপরও বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। ডোপ টেস্ট পজিটিভ আসার পর গেণ্ডারিয়া থানার এক এসআইকে পুলিশের রমনা বিভাগে ন্যস্ত করা হয়। তিনি জানান, নেশাগ্রস্ত না হলেও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে নেশাগ্রস্ত বানানো হয়েছে। নিজ উদ্যোগে একাধিক হাসপাতালে পরীক্ষা করিয়ে নেগেটিভ ফলাফল পেয়েছি।ডোপটেস্টের রিপোর্ট একবার পজিটিভ, আরেকবার নেগেটিভ কেন হয়- জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, মাদক গ্রহণের নির্দিষ্ট সময় পর এর কার্যকারিতা থাকে না। দেরিতে পরীক্ষা করানো হলে ফলাফল নেগেটিভ আসে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, হেরোইন সেবনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টেস্ট করানো হলে পজিটিভ আসে। ২৪ ঘণ্টা পর পজিটিভ রিপোর্ট আসার সম্ভাবনা নেই। তিনি আরও বলেন, হেরোইন গ্রহণের পর কোনো ব্যক্তি দ্রুত ঘামলে এবং বেশি বেশি প্রস্রাব করলে শরীর থেকে হেরোইনের কার্যকারিতা দ্রুত চলে যায়।ডিএমপি সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ডোপ টেস্টের বিষয়ে পুলিশ কমিশনার কঠোর অবস্থানে। এ কারণে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিভিন্ন ইউনিট প্রধানরা। এছাড়া মাঠ পর্যায়েও কাজ করছেন কমিশনারের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট। এর মধ্যে থেকে বাদ পড়ছেন না কর্মকর্তারাও। তাদের চলাফেরার ওপরও নজরদারি রয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও কাজ করছে। পাশাপাশি সিটি এসবির সদস্যদের বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সন্দেহভাজন উচ্চপদস্থ পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট করা হবে বলে পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান।ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সন্দেহভাজন পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট করানোর ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। প্রথম অবস্থায় নিজস্ব লোকের মাধ্যমে সন্দেহভাজনদের তালিকা করা হচ্ছে। এরপর ডিএমপি কমিশনার কার্যালয়ে সেই তালিকা পাঠানো হচ্ছে। সেখান থেকে সদস্যকে ডিএমপি সদর দফতরে হাজির হতে বলা হচ্ছে। এরপর তাকে সেখান থেকে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে প্রয়োজনীয় টেস্ট করানো হচ্ছে। তিনি বলেন, কমিশনারের নির্দেশের পর তার বিভাগে কয়েকজনকে টেস্ট করানো হয়। এর মধ্যে দু’জনের ফলাফল পজিটিভ এসেছে।জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, বর্তমান আইজিপি দায়িত্ব গ্রহণের পর পাঁচটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য হল- মাদক নির্মূল করা। আর মাদক নির্মূল করতে হলে আগে ঘর থেকে শুরু করতে হবে। সোহেল রানা আরও বলেন, পুলিশের কোনো সদস্য মাদক গ্রহণ করবে না, কাউকে গ্রহণ করতেও দেবে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে পুলিশের চাকরি থাকবে না। পুলিশ সদস্যদের মাদকমুক্ত রাখতে কঠোর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি করে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। পুলিশ সদস্যরা যাতে মাদকের সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট না হন সেজন্য প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক ব্রিফিং করা হচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করা হচ্ছে।

Leave your comments