রংপুরের তিনটি আদালতে ১২ থেকে ১৭ বছর ধরে বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা প্রায় এক হাজার মামলা।এর ফলে বিচারপ্রার্থী নারী ও শিশু এবং তাদের পরিবারের দিন কাটছে প্রচণ্ড যন্ত্রণায়।এই পাশবিক বর্বরতার স্মৃতি তারা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।নষ্ট হচ্ছে তাদের সামাজিক,পারিবারিক জীবন।অনেকক্ষেত্রে নষ্ট হচ্ছে অর্থনৈতিকভাব স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ।পাশাপাশি ধর্ষক ও তাদের পরিবার কখনও হুমকি দিয়ে,কখনও টিটকারি মেরে কখনওবা প্রকাশ্যে অপমান করে তাদের হেয়প্রতিপন্ন করছে।এরপরও সুবিচার পাওয়ার আশায় আদালতের বারান্দায় তারা ঘোরাঘুরি করলেও সরকারি ও আসামিপক্ষের আইনজীবী, পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার কারণে মামলাগুলোর চূড়ান্ত রায় সহজেই হচ্ছে না।সব মিলিয়ে রংপুরে এখন ধর্ষণের প্রায় আড়াই হাজারের মতো মামলা বিচারাধীন আছে বলেও আইনজীবীরা জানিয়েছেন।সম্প্রতি সংশোধনের আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাটি নিষ্পত্তির নির্ধারিত সময় বেঁধে দেওয়া থাকলেও শেষ না হলে কী হবে তার উল্লেখ না থাকায় এই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন আইনজীবীরা।ফলে দফায় দফায় মামলার তারিখ পড়ে ও পিছিয়ে যায়।মামলার এভিডেন্স দুর্বল হতে থাকে ও সাক্ষী হাজিরে যথেষ্ট সময়ক্ষেপণের সুযোগ পান আইনজীবীরা।অনেক সময় সাক্ষী নিজেও আসতে চায় না।আইনজীবীদের এই কূট চালে বিচারকও নতুন তারিখে আসামি হাজির করার নির্দেশ বা শুনানি ইত্যাদির নির্দেশ দেন।ফলে বছরের পর বছর ধরে এ মামলাগুলো প্রলম্বিত হচ্ছে।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের যথাযথ সহযোগিতা না পাওয়া,বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা, বিচারক সংকট ইত্যাদি কারণও মামলা ঝুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।পুরনো আইনটির এমন নানা গোলক ধাঁধায় ধর্ষণ মামলার বাদীরা এমন পেরেশানিতে পড়ছেন যে মামলা আর চালিয়ে যাবেন কিনা তা নিয়েই সংশয়ে ভোগেন অনেকে।বিরক্ত হতে হতে এক সময় বাদী যেন ভুলেই যান কী কারণে আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি!আদালত সূত্রে জানা গেছে,রংপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত রয়েছে তিনটি।এই তিনটি আদালতে ১২ বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত সময় ধরে প্রায় এক হাজার ধর্ষণের মামলা বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে।গত দুই সপ্তাহে তিনটি মামলায় আসামিদের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে।ওই তিনটি মামলাই ১৫ থেকে ১৬ বছর আগে দায়ের করা।এ ব্যাপারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট খন্দকার রফিক হাসনাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজেও স্বীকার করেন তার আদালতে তিনশ’র মতো ধর্ষণের মামলা বিচারের অপেক্ষায় পড়ে আছে।এর বেশিরভাগই আবার ১২ থেকে ১৫ বছর ধরেই ঝুলে আছে।এর পেছনে প্রধান চারটি কারণ চিহ্নিত করেন তিনি।সরকারি এই আইনজীবীর বিবেচনায় এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে মামলার সংখ্যাধিক্য ও বিচারক সংকট।নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে মামলার সংখ্যা বেশি।এ কারণে একটি মামলায় বছরে দুই থেকে তিনটার বেশি শুনানির তারিখ পড়ে না।ফলে বছর পার হয়ে যায়।একজন বিচারকের পক্ষে এতগুলো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করাও সম্ভবপর হয় না।২য়ঃমামলার বাদী ও সাক্ষীরা আদালতে সময়মতো সাক্ষী দিতে আসেন না।৩য়ঃ মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতা।পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে আদালতে সাক্ষী হাজির করা। কিন্তু, আদালত সাক্ষীদের নামে সমন বা ওয়ারেন্ট জারি করার পরেও পুলিশ কর্মকর্তারা সাক্ষী হাজির করতে পারেন না।৪য়ঃআসামিপক্ষ নানান অজুহাতে মামলার বিচার শেষ করতে বিলম্ব করেন।ফলে দীর্ঘদিন ধরে বিচারের অপেক্ষায় পড়ে আছে মামলাগুলো।তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, আগে আদালতে কেউ সাক্ষ্য দিতে এলে সরকারিভাবে তাদের যাতায়াতসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচ দেওয়া হতো।কিন্তু,এখন সেই টাকা প্রদান করা বন্ধ হয়ে গেছে।এজন্য বরাদ্দ দেওয়া হলে সাক্ষীরাও আদালতে সাক্ষ্য দিতে উৎসাহিত হতো।সাক্ষীরা নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে উৎসাহ বোধ করেন না,তাই সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে মামলা ঝুলে যেতেই থাকে।নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলাগুলো ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।কিন্তু এরপরেও রায় পেতে কেন এত বিলম্ব হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার করতে হবে বলা থাকলেও বিচার শেষ না করলে কী হবে তা আইনে বলা নেই।ফলে অনেকেই এর সুযোগ নিচ্ছেন।ধর্ষণের মামলা দীর্ঘসময় ধরে ঝুলে থাকার বিষয়ে আরও জানতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিশেষ পিপি জাহাঙ্গীর হোসেন তুহিন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও স্বীকার করেন তাদের আদালতে তিনশর বেশি মামলা বিচারাধীন আছে।এগুলোর মধ্যে কিছু ঝুলে আছে ১২ থেকে ১৭ বছর ধরে।এর কারণ হিসেবে তিনি দাবি করেন,সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেন না।বিশেষ করে ডাক্তার সাক্ষীরা বছরের পর বছর ধরে আসেন না।তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারাও সাক্ষ্য দিতে আসেন না।এছাড়া আসামিপক্ষ বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করেন।তবে বিচারক এখন ধর্ষণের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান তিনি।জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু দীর্ঘদিন ধরে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বিচার বিলম্বিত হওয়ার জন্য পাবলিক(পিপি)দায়ী করেন।তিনি বলেন,এসব মামলা ঝুলে থাকার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারপক্ষের আইনজীবী হিসেবে পাবলিক প্রসিকিউটরদের (পিপি) ব্যর্থতা,দায়িত্বহীনতা ও জ্ঞানের অভাব।কারণ,পিপি সাহেবদের দায়িত্ব আদালতকে সাহায্য করা।মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার আইনগত বাধ্যবাধকতা মানছেন না কেউই।
দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এসব মামলার বিচার শেষ করতে আরও একাধিক আদালত স্থাপনের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি।এ ব্যাপারে রংপুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি আব্দুল মালেক অ্যাডভোকেট জানান,নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে ঝুলে থাকা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।ফলে আর ঝুলে থাকবে না কোনও মামলাই।তবে এসব মামলার বিচার কাজ শেষ হতে

Leave your comments