দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত পাঁচ বছরে দুর্নীতির অভিযোগে যত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে, তার অর্ধেকই সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী।অথচ দুর্নীতি কমার আশা নিয়ে পাঁচ বছর আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতন ৯১ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।দুদকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তারা দুর্নীতির মামলায় ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।তাঁদের মধ্যে ৩৯০ জনই​ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।বাকিদের মধ্যে ১৫৪ জন বিভিন্ন ব্যাংকের এবং ২৩ জন নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য শ্রেণি–পেশার আছেন ১৯৭ জন, আর জনপ্রতিনিধি ৩৫ জন।জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার ৭৯৯ জনের অর্ধেক যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়, উল্টো দিকেও তো অর্ধেক আছে।দুদকের হিসাব বলছে, স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দুর্নীতি বেড়েছে। পরিস্থিতি এমন যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদককে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ২৫ দল গঠন করতে হয়েছে।দুদকের মামলায় সম্পৃক্ত অবৈধ সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্যও পৃথক ইউনিট গঠন করা হয়েছে।এ ছাড়া সরকারি দপ্তর ও সেবা সংস্থাগুলোতে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধের জন্য ১৫টি মন্ত্রণালয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।সর্বশেষ করোনা মহামারিকালেও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অভিযোগে দুদক যাঁদের তলব, জিজ্ঞাসাবাদ ও মামলার আসামি করেছে, তাঁদের অধিকাংশই ​সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। বাকিরা এই খাতের ব্যবসায়ী।দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকাই দুর্নীতি বাড়ার বড় কারণ।তিনি বলেন, ‘সিস্টেম জনবান্ধব হলে ব্যক্তি কখনো মুখ্য হয় না। মানুষ যখন কাজের জন্য এসে দেখে, দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে, তখনই সে অন্ধকার পথ খোঁজে।সরকারি অফিসে দুর্নীতি কমাতে ‘শুদ্ধাচার কৌশল’ বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন।তিনি প্রথম আলোকে বলেন,সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যাঁরা দুর্নীতি করে ধরা পড়েন, আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করি এবং বরখাস্ত করি।জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন করে।এরপরও দুর্নীতি যে হয় না, তা নয়।দুদককেও আরও শক্তিশালী করতে হবে।’৯৭ শতাংশই ছোটরা দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন।তারা বিভিন্ন সময় সন্দেহভাজনদের সম্পদের হিসাব নেয়, জিজ্ঞাসাবাদ এবং মামলা দায়ের করে।যা ফলাও করে প্রচারও করা হয়। কিন্তু দুদকের মামলায় গত পাঁচ বছরে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ৯৭ শতাংশের বেশি ছোট পদের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধি।এ তালিকায় হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া উচ্চপর্যায়ের সরকারি আমলা, মন্ত্রী, সাংসদ ও প্রভাবশালী কেউ নেই।দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল,বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ তথ্য প্রমাণ করছে, দুদক নিম্ন কিংবা মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের প্রাধান্য দিচ্ছে বেশি।উচ্চপর্যায়ের লোকদের বিচারের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত খুব কম।সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক ও কর্মচারী আবজাল হোসেনকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয় দুদক। এই খাতে দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি ২৫ জনকে তলব করেছে, যাঁদের অধিকাংশই ছোট পদের কর্মকর্তা-কর্মচারী। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার নজির খুবই কম। যেমন অনেক আলোচনা–সমালোচনার পরেও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়নি।দুদকের চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংখ্যায় হয়তো বড়রা কম।আমি মাঠপর্যায় থেকে কাজ করে এসেছি।সাধারণ মানুষ কিন্তু বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিম্নস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে।আর বড়রা আটঘাট বেঁধে দুর্নীতি করে।তাদের কাজটা হয় ফাইলে।আমি দুর্নীতি টের পেলাম, কিন্তু নথিতে যদি কিছু পাওয়া না যায়, মামলা করে কোর্টে কীভাবে প্রমাণ করবেন?’৭৯,৩৬৫ অভিযোগ, ১,২১১ মামলা,দুদকের পাঁচ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন ও হিসাব পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, দুর্নীতির অভিযোগ আসার পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৫ সালে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে ১০ হাজার ৪১৫টি।পরের বছরগুলোতে তা বাড়তে থাকে।গত বছর সর্বোচ্চ ২১ হাজার ৩৭১টি অভিযোগ পড়ে।এটাকে দুদকের প্রতি নাগরিকদের আস্থার সমর্থন বলে মনে করে সংস্থাটি।দুদক সূত্র জানায়,গত পাঁচ বছরে দুদক মোট ৭৯ হাজার ৩৬৫টি অভিযোগ পেয়েছে।যাচাই-বাছাই শেষে ৬ হাজার ১৫৯টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য নিয়েছে।এগুলোর মধ্যে মামলা করেছে ১ হাজার ২১১টি।এসবের মধ্যে ২০১৬ সালে ৩৫৯টি, ২০১৭ সালে ২৭৩টি, ২০১৮ সালে ২১৬টি, ২০১৯ সালে ৩৬৩টি মামলা হয়। চলতি বছরের হিসাব এখনো শেষ হয়নি।এ ছাড়া দুদকের এখতিয়ারের বাইরে ৬ হাজার ১৬১টি অভিযোগের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।সাজা কতটা হয়ঃদুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতই কথা বলুক,তাতে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।দুদকের মামলায় শেষ পর্যন্ত আসামিদের সাজা কতটা টেকে,তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে।যদিও দুদক বলছে, তাদের পক্ষ থেকে যেসব মামলা দায়ের করা হচ্ছে, সেগুলোতে সাজার হার প্রতিবছরই বাড়ছে।যেমন ২০১৫ সালে মামলায় সাজার হার ছিল ৩৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৫৪ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৬৮ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৬৩ শতাংশ ও ২০১৯ সালে ৬৩ শতাংশ।আর চলতি বছরে দুদকের ৯২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।এগুলোর মধ্যে ২১টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন।সাজা হয়েছে ৭১টিতে।সাজার এই হারকে ‘মন্দের ভালো’ বলে মন্তব্য করেন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারিক আদালতে সাজার এই হার খারাপ নয়, ভালো।এটা শতভাগে যাওয়া উচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা আপিল বিভাগ পর্যন্ত।
Leave your comments