কুড়িগ্রামে গত দুই-তিন মাস ধরে বেড় চলেছে হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ। এতে জনমনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় সবকটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উৎঘাটন করতে সক্ষম এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিদের গ্রেফতার করায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। পুলিশ বলছে- এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে পারিবারিক কলহ, সুদের টাকার লেনদেন, মাদক ও নারী সংশ্লিষ্ট শত্রুতাই দায়ী।

সম্প্রতি কুড়িগ্রাম জেলা শহরের হাটির পাড় এলাকায় নিজ ঘরে শারমিন নামে এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার, কেন্দ্রীয় বাস
টার্মিনালে পার্কিং করে রাখা একটি বাসের ভেতর থেকে শিশু হেলপারের লাশ উদ্ধার, নাগেশ্বরী পৌর এলাকায় নিজ
বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর লাশ উদ্ধার, একই এলাকায় রাস্তার পাশে ধানক্ষেত থেকে রাজা নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার,
রৌমারীতে স্কুলছাত্রী মমতাজ হত্যাকাণ্ড ও উলিপুর উপজেলার ধানক্ষেত থেকে এক পল্লী চিকিৎসকের লাশ উদ্ধারের
ঘটনায় জেলায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

যে কারণে এসব হত্যাকাণ্ড

গত ২৭ সেপ্টেম্বর নাগেশ্বরী উপজেলার পৌর এলাকার নিজ বাড়ি থেকে নজরুল ইসলাম ম্যানা ও রুমি বেগম দম্পতির
মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে রমজান, মাইদুল ও সাইদুরসহ ছয় আসামিকে
গ্রেফতার করে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ জানায়, সুদের টাকার লেনদেন নিয়ে সৃষ্ট শত্রুতার জেরে খুন হন ওই
দম্পতি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

এ ঘটনার একদিন পরই ২৮ সেপ্টেম্বর জেলা শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে পার্কিং করা একটি বাসের ভেতর থেকে শিশু
হেলপার শিপনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, শিপনের কাছে থাকা একটি এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিতে
গিয়ে সহকর্মী সোহেল ইসলামের হাতে তার মৃত্যু হয়। পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সোহেলকে গ্রেফতার করে
পুলিশ। সে আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

গৃহবধূ শারমিন হত্যা

গত ৯ অক্টোবর কুড়িগ্রাম শহরের হাটির পাড় এলাকায় নিজ ঘর থেকে গৃহবধূ শারমিন আক্তারের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ
ঘটনায় ওই গৃহবধূর মাদকাসক্ত স্বামী মাইদুল ইসলাম বাবুকে ঢাকার কমলাপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ
জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে তার স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে।

এর কয়েকদিন পর গত ১৯ , ২০ ও ২১ অক্টোবর পরপর তিনটি লাশ উদ্ধারের ঘটনায় জেলায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
এসময় জেলাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে সাধারণ মানুষ।

১৯ অক্টোবর নাগেশ্বরী পৌর এলাকার নাগেশ্বরী-ফুলবাড়ী সড়কের বালাটারী জোড়াব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় রাস্তার পাশে একটি
ধানক্ষেত থেকে রাজা নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনাকে পুলিশ সড়ক দুর্ঘটনা দাবি করলেও
পরিবারের দাবি, মাদক ব্যবসায়ীরা রাজাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। পরে সড়ক দুর্ঘটনার
নাটক সাজানো হয়। পুলিশ এখনও রাজার মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উৎঘাটন করতে পারেনি।

শিক্ষার্থী মমতাজ আক্তার হত্যা

এ ঘটনার পরের দিন ২০ অক্টোবর রৌমারী উপজেলার শৌলমারী ইউনিয়নের ঘুঘুমারির চরের একটি কাশবন থেকে
নিখোঁজের চার দিন পর অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মমতাজ আক্তার জিম্মির হাত ও মুখ বাঁধা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
ঘটনার ২২ দিন পর মমতাজ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচ যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়,
প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় রাজ্জাক ও তার চার সহযোগী মিলে হত্যা করে মমতাজকে।

এর একদিন পরই উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের সোনাপুর বাজারের পাশে একটি ধানক্ষেত থেকে
জয়নাল আবেদীন নামে এক পল্লী চিকিৎসকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরকীয়া প্রেমের সম্পর্কের জেরে এ
হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে হাফিজুর নামে এক ব্যক্তিসহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার
কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে হাফিজুর।

এসব হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে মাদক ও সুদের ব্যবসার প্রসাররোধসহ সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন বলে
মনে করছে সচেতন মহল।

অধিকাংশ পরিবার মাইগ্রেটেড

কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি, সাংবাদিক ও সামাজিক সংগঠক সফি খান বলেন,জেলায় অধিকাংশ পরিবার
মাইগ্রেটেড। এসব পরিবার সামাজিক বন্ধন থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে সামান্য কলহের কারণে অনেক
সময় হত্যাকাণ্ডের মতো বড় বড় ঘটনা ঘটছে।

তিনি আরও বলেন,জেলায় বিশাল এলাকাজুড়ে উন্মুক্ত সীমান্ত থাকায় মাদকের বিস্তার ঘটছে। মাদকের বিস্তার রোধে কঠোর
পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কোনও বিকল্প নেই।

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, কুড়িগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সংস্কৃতিকর্মী দুলাল বোস বলেন, সম্প্রতি কুড়িগ্রাম জেলায়
হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নাগরিক সমাজ কিছুটা উদ্বিগ্ন। এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জেলা কমিউনিটি
পুলিশিং ইউনিটগুলোকে সক্রিয় করা প্রয়োজন। ওয়ার্ড বা ইউনিয়নভিত্তিক এসব কমিটি সংশ্লিষ্ট এলাকার ছোট ছোট
বিরোধগুলো যেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় নিরসন করতে পারবে তেমনি বড় ধরনের কোনও অপরাধ সংঘটিত
হওয়ার আগেই তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্রুত জানাতে পারবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার মাদকের বিস্তার রোধেও এসব
কমিটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

হত্যাকাণ্ডের রহস্য উৎঘাটন

কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার মো. মহিবুল ইসলাম খান বলেন, পুলিশ ইতিমধ্যে প্রায় সবকটি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উৎঘাটনসহ
আসামিও গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এসব ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশ জেলার কমিউনিটির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ
শুরু করেছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ মসজিদভিত্তিক মত বিনিময় ও উঠান বৈঠক চলমান রয়েছে।

জেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তথ্য আদান-প্রদানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলাদা পেজ খুলে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে
তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন।এছাড়াও কমিউিনিটি পুলিশিং ইউনিটগুলোকে নতুন
করে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জেলার সব পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে
যাতে সাধারণ মানুষ যেকোনও সমস্যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে পারেন। আশা করছি এসব ঘটনার আর
পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

মাদকের বিস্তার রোধে পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে মহিবুল ইসলাম খান বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা জিরো টলারেন্সে রয়েছি।

ফিরোজ কবির কাজল

আরো পড়ুনঃ  যে যে কারণে কুড়িগ্রামে বেড়েই চলেছে হত্যাকাণ্ড

Leave your comments